শির্কের হাকিকত ও তার প্রকারসমূহ কি ?
অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
প্রশ্ন: আমি প্রায় পড়ি “এটা বড় শির্ক ওটা ছোট শির্ক”, কিন্তু বিষয়গুলো আমার নিকট স্পষ্ট নয়, আপনি কি আমাকে শির্কের হাকিকত এবং ছোট ও বড় শির্কের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট করে বলবেন?
উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ,
মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের জন্যই শির্কের অর্থ,
ভয়াবহতা ও তার প্রকারসমূহ জানা ফরয ও অবশ্য জরুরি,
তবেই তার তাওহীদ পরিপূর্ণ, ইসলাম নিরাপদ ও ঈমান বিশুদ্ধ হবে। অতএব আল্লাহর উপর ভরসা করে বলছি, তিনি আপনাকে তার হিদায়েতের তাওফিক দান করুন। জেনে রাখুন,
শির্কের আভিধানিক অর্থ অংশীদার সাব্যস্ত করা, অর্থাৎ কাউকে অপরের অংশীদার বানানো। সাধারণত দু’জনের মাঝে কোনো বস্তু বণ্টন করা হলে বলা হয়: أشرك بينهما ‘সে তাদের উভয়ের মাঝে শরীক করেছে’,
অথবা বলা হয়: أشرك في أمره غيره ‘সে তার বিষয়ে অপরকে অংশীদার করেছে’, যখন বিষয়টি দু’জনের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
শরীয়তের পরিভাষায় শির্ক: আল্লাহর রুবুবিয়াত অথবা তার ইবাদত অথবা তার নাম ও গুণাবলিতে অংশীদার বা সমকক্ষ নির্ধারণ করা।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারিমের বহু আয়াতে তার সমকক্ষ ও শরীক গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন, যারা তার সমকক্ষ নির্ধারণ করে, তাদের তিনি নিন্দা করেছেন, যেমন তিনি বলেন:
﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا
وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢]
“সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না”।[1]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا
لِّيُضِلُّواْ عَن سَبِيلِهِۦۗ قُلۡ تَمَتَّعُواْ فَإِنَّ مَصِيرَكُمۡ إِلَى
ٱلنَّارِ ٣٠ ﴾ [ابراهيم: ٣٠]
“আর তারা আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করে, যেন তারা তার পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে। বল, ‘তোমরা ভোগ করতে থাক, কেননা, তোমাদের গন্তব্য তো আগুনের দিকে”।[2]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «من مات وهو يدعو من دون الله ندا دخل النار»
“যে এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহ ছাড়া কোনো সমকক্ষ আহ্বান করত, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে”।[3]
শির্কের প্রকার:
কুরআন ও হাদিসের দলিলসমূহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর সাথে শির্ক ও তার সমকক্ষ নির্ধারণের ফলে ব্যক্তি কখনো দীন থেকে বের হয়ে যায়,
কখনো দীন থেকে বের হয় না। এ জন্য আলেমগণ শির্ককে দু’ভাগে ভাগ করেছেন:
বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। নিম্নে প্রত্যেক প্রকার শির্কের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করা হল:
এক. বড় শির্ক বা শির্কে আকবার:
শির্কে আকবার বলা হয়,
একমাত্র আল্লাহর হককে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে নিবেদন করা, যেমন তার রুবুবিয়াতের কোনো অংশ,
অথবা তার উলুহিয়াতের কোনো অংশ,
অথবা তার নাম ও গুণাবলির কোনো অংশকে তিনি ব্যতীত কাউকে নিবেদন করা বড় শির্ক।
এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় প্রকাশ্য,
যেমন দেবদেবী ও মূর্তি পূজকদের শির্ক; কবর-মাজার, মৃত ও গায়েবি ব্যক্তি পূজকদের শির্ক ইত্যাদি।
কখনো হয় অপ্রকাশ্য, যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রভুদের উপর ভরসাকারীদের শির্ক। অথবা যেমন মুনাফিকদের কুফর ও শির্ক, তাদের শির্ক যদিও বড়-ব্যক্তিকে দীন থেকে বের করে দেয় এবং তারা চিরদিন জাহান্নামে থাকবে,
তবুও এ শির্ককে খফি ও অপ্রকাশ্য শির্ক বলা হয়,
কারণ তারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করে অন্তরে কুফর ও শির্ক গোপন করেছে, তাই তারা অপ্রকাশ্য মুশরিক, বাহ্যিকভাবে নয়।
এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় আকিদাগত,
যেমন বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর সাথে কোনো সত্তা আছে যে সৃষ্টি করে, অথবা জীবিত করে,
অথবা মৃত্যু দেয়,
অথবা মালিকানার হকদার,
অথবা এ জগতে কর্তৃত্বের অধিকারী।
অথবা এরূপ বিশ্বাস করা যে, অমুক সত্তা আল্লাহর ন্যায় নিঃশর্ত আনুগত্যের হকদার,
ফলে সে কোনো বস্তু হালাল ও হারাম করার ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার আনুগত্য করে,
যদিও তা রাসূলদের আনিত দীনের বিপরীত হয়।
অথবা মহব্বত ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শির্ক করা, যেমন আল্লাহকে মহব্বত করার ন্যায় কোনো মখলুককে মহব্বত করা। এ জাতীয় শির্ক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, এ শির্কের ব্যাপারে তিনি বলেছেন:
﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ
ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ ١٦٥ ﴾ [البقرة: ١٦٥]
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে”।[4]
অথবা এমন বিশ্বাস করা যে,
কোনো সত্তা আছেন যিনি আল্লাহর সাথে গায়েব জানেন। এ জাতীয় বিশ্বাস সাধারণত গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট দলসমূহে বেশী দেখা যায়,
যেমন শিয়া-রাফেযী,
সূফী ও বাতেনি ফেরকাসমূহ। শিয়া-রাফেযিরা তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে তারা গায়েব জানেন, অনুরূপ বাতেনি ও সূফীরা তাদের অলীদের ব্যাপারে গায়েব জানার ধারণা করে। অথবা এরূপ বিশ্বাস করা যে, কোনো সত্তা আছেন যে আল্লাহর ন্যায় অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে পারেন, যেমন পাপ মোচন করা, বান্দাদের ক্ষমা করা ও তাদের অপরাধ মাফ করা।
এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় কথা-বার্তায়,
যেমন আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট দোয়া করা,
অথবা ফরিয়াদ করা,
অথবা সাহায্য তলব করা, অথবা আশ্রয় প্রার্থনা করা, হোক সে নবী,
অথবা অলী, অথবা ফেরেশতা অথবা জিন, অথবা অন্য কোনো মখলুক। এ সব বড় শির্ক, মানুষকে দীন থেকে বের করে দেয়।
অথবা আল্লাহর দীনের সঙ্গে ব্যঙ্গ করা, অথবা আল্লাহকে তার মখলুকের সঙ্গে তুলনা করা,
অথবা আল্লাহর সাথে দ্বিতীয় কাউকে সৃষ্টিকর্তা, অথবা রিজিকদাতা, অথবা পরিকল্পনাকারী জ্ঞান করা। এসবই বড় শির্ক ও মহাপাপ যা ক্ষমা করা হবে না।
কখনো এ জাতীয় শির্ক প্রকাশ পায় কাজে,
যেমন আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্য যবেহ করা,
অথবা সালাত পড়া অথবা সেজদা করা, অথবা আল্লাহর বিধানের ন্যায় বিধান রচনা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া এবং তা মেনে নিতে বাধ্য করা। অনুরূপ কাফেরদের পক্ষ নেওয়া ও মুমিনদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করা,
ইত্যাদি কর্মগুলো মৌলিক ঈমান পরিপন্থী এবং ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আল্লাহর নিকট এসব শির্ক থেকে আমরা ক্ষমা ও নিরাপত্তা চাই।
দুই. ছোট শির্ক:
যেসব শির্ক বড় শির্কের বাহন, অথবা যেসব শির্ককে কুরআন ও সুন্নায় ছোট শির্ক বলা হয়েছে, যতক্ষণ না সেগুলো বড় শির্কের পর্যায়ে পৌঁছে,
ছোট শির্ক।
এ জাতীয় শির্ক সাধারণত দু’ভাবে হয়:
১. কোনো বস্তুকে উপায় হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহ যার অনুমতি প্রদান করেননি,
যেমন হাতের পাঞ্জা ও পুঁতি ইত্যাদি এ বিশ্বাসে ঝুলিয়ে রাখা যে,
এগুলো নিরাপত্তার উপায়,
অথবা নজর লাগা প্রতিহত করবে,
অথচ আল্লাহ সেগুলোকে শরীয়ত ও তাকদীর কোনো বিচারেই উপায় বানাননি।
২. কোনো মহান বস্তুকে অতিরিক্ত সম্মান দেওয়া-যা আল্লাহর রুবুবিয়াতের সমান নয়, যেমন গায়রুল্লাহর নামে কসম খাওয়া;
অথবা এরূপ বলা যে, ‘যদি আল্লাহ ও সে না থাকত
...’ ইত্যাদি ছোট শির্কের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি আল্লাহর রুবুবিয়াতের সমপরিমাণ মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে বড় শির্ক।
আলেমগণ কতক নীতিমালা তৈরি করেছেন, যার দ্বারা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত শির্কগুলো ছোট-বড় দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন:
১. কোনো কাজকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ছোট শির্ক আখ্যা দেওয়া, যেমন মাহমুদ ইবনে লাবিদ সূত্রে মুসনাদে আহমদে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ
أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ . قَالُوا يَا رَسُولَ
اللَّهِ : وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ؟ قَالَ :الرِّيَاء . إِنَّ اللَّهَ
تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ يَوْمَ تُجَازَى الْعِبَادُ بِأَعْمَالِهِمْ
اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ بِأَعْمَالِكُمْ فِي الدُّنْيَا
فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً»
“নিশ্চয় সবচেয়ে বড় ভয়, যা আমি তোমাদের উপর আশঙ্কা করি, তা হচ্ছে ছোট শির্ক। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল, ছোট শির্ক কি? তিনি বললেন: ‘রিয়া’, [লোক দেখানো আমল]। আল্লাহ তা‘আলা [রিয়াকারীদের] বলবেন, যে দিন বান্দাদেরকে তাদের আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে, তোমরা তাদের কাছে যাও, দুনিয়াতে যাদেরকে তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে, দেখ তাদের নিকট কোনো প্রতিদান পাও কিনা”।[5]
২. কুরআন ও হাদিসের কোথাও যদি শির্ক শব্দটি অনির্দিষ্টভাবে তথা নাকেরাহ ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ তার সাথে আলিফ ও লাম পদাশ্রিত নির্দেশক দু’টি হরফ সংযুক্ত না থাকে, তাহলে সাধারণত তার উদ্দেশ্য হয় ছোট শির্ক। এ প্রকার শির্কের উদাহরণ অনেক, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إن الرقى والتمائم والتِّوَلَة شرك»
“নিশ্চয় ঝাড়-ফুক[6], তাবিজ ও তিওয়ালাহ্ হচ্ছে শির্ক”।[7]
এ হাদিসে شرك শব্দটি পদাশ্রিত নির্দেশক দু’টি হরফ ال বিহীন এসেছে, তাই এ শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য ছোট শির্ক, বড় শির্ক নয়[8]।
তামিমাহ: মাদুলি জাতীয় বস্তু, যা বদ নজর থেকে সুরক্ষার জন্য বাচ্চাদের গলায় ঝুলানো হয়।
তিওয়ালাহ: এটা তামিমাহ জাতীয় বস্তু, যা স্ত্রীকে স্বামীর নিকট ও স্বামীকে স্ত্রীর নিকট প্রিয়পাত্র বানানোর জন্য দেওয়া হয়।
৩. কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত শির্ক শব্দের অর্থ যদি সাহাবিগণ ছোট শির্ক বলেন, তাহলে তার উদ্দেশ্য ছোট শির্ক। সাহাবিদের কথা আমাদের জন্য দলিল, কারণ তারা আল্লাহর দীনকে সবচেয়ে বেশী বুঝতেন এবং শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য সবচেয়ে বেশী জানতেন। একটি উদাহরণ, ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ ইবনে মাসদউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
ثَلاثًا ، وَمَا مِنَّا إِلا وَلَكِنَّ اللَّهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّل»
“কুলক্ষণ নেওয়া শির্ক, কুলক্ষণ নেওয়া শির্ক, তিনবার। আমাদের মধ্যে কেউ নেই, তবে অবশ্যই [সে কুলক্ষণ গ্রহণ করে], কিন্তু তাওয়াক্কুলের কারণে আল্লাহ তা দূর করে দেন”।[9]
বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বলেছেন এ হাদিসে وَمَا مِنَّا إِلا থেকে পরবর্তী অংশ ইবনে মাসউদের বাণী। তার এ কথা প্রমাণ করে, তিনি বুঝেছেন কুলক্ষণ নেওয়া ছোট শির্ক, অন্যথায় তার কথা وَمَا مِنَّا إِلا এর অর্থ দাঁড়ায় “আমাদের মধ্যে কেউ নেই, যে বড় শির্কে পতিত হয় না”, যা বাস্তবতার বিপরীত। দ্বিতীয়ত বড় শির্ক আল্লাহ তা‘আলা তাওয়াক্কুলের কারণে দূর করেন না, বরং তার জন্য তাওবা জরুরি। অতএব এ হাদিসে শির্ক অর্থ ছোট শির্ক।
৪. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক শির্ক অথবা কুফর শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া যে, তার দ্বারা ছোট শির্ক উদ্দেশ্য, বড় শির্ক নয়, যেমন ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে হুদাইবিয়ায় সকালের সালাত আদায় করলেন, সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সালাত শেষে তিনি মানুষের দিকে মুখ করে বসলেন, অতঃপর বললেন:
«هَلْ
تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ ؟ " قَالُوا : اللَّهُ وَرَسُولُهُ
أَعْلَمُ . قَالَ : أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ
قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِي كَافِرٌ
بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِي
مُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ»
“তোমরা কি জান, তোমাদের রব কি বলেছেন”? তারা বলল: আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি [আল্লাহ] বলেছেন: “আমার কতক বান্দা আমার উপর ঈমানের হালতে ভোর করেছে, আর কতক কাফের অবস্থায়। অতএব যে বলেছে: আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী ও তারাসমূহের (প্রভাবের) প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে: অমুক অমুক তারার কারণে বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী ও তারাসমূহের (প্রভাবের) প্রতি বিশ্বাসী”।[10]
এ হাদিসে কুফর শব্দের অর্থ অপর হাদিসে এসেছে, যা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«أَلَمْ تَرَوْا إِلَى مَا قَالَ رَبُّكُمْ ؟ قَالَ : "مَا
أَنْعَمْتُ عَلَى عِبَادِي مِنْ نِعْمَةٍ إِلَّا أَصْبَحَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ بِهَا
كَافِرِينَ يَقُولُونَ الْكَوَاكِبُ وَبِالْكَوَاكِبِ»
“তোমরা কি দেখনি তোমাদের রব কি বলেছে? তিনি বলেছেন: “আমি আমার বান্দাদের উপর যখনই কোনো অনুগ্রহ করেছি তখনই তাদের একদল তা অস্বীকারকারী অবশ্যই হয়েছে, তারা বলে তারকা ও তারকা দ্বারা”।
এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, বৃষ্টি বর্ষণকে যে তারকার সাথে সম্পৃক্ত করল তারকা বৃষ্টি বর্ষণের কারণ হিসেবে, যদিও আল্লাহ তাকে বৃষ্টি বর্ষণের কারণ বানাননি,
তার কুফরি হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করার কুফরি। আর নিয়ামতের কুফরি হচ্ছে ছোট কুফরি। হ্যাঁ,
যে বিশ্বাস করে তারকাই জগতে কর্তৃত্ব করে এবং তারকাই বৃষ্টি বর্ষণ করে, তাহলে এটা বড় শির্ক।
• ছোট শির্ক কখনো হয় প্রকাশ্য,
যেমন কড়ি, তাগা ও তাবিজ পরিধান করা প্রকাশ্য ছোট শির্ক।
• আবার ছোট শির্ক কখনো হয় অপ্রকাশ্য, যেমন অল্প রিয়া
(সামান্যতম লোক দেখানো বা লোক শোনানোর প্রবণতা)।
• ছোক শির্ক কখনো হয় বিশ্বাসে,
যেমন কেউ কোনো বস্তু সম্পর্কে বিশ্বাস করল যে, তা উপকার হাসিল ও অনিষ্ট দূরীকরণের উপায়,
অথচ আল্লাহ তাকে ভালো-মন্দের উপায় বানাননি। অথবা কোনো বস্তুতে বরকতের বিশ্বাস করল,
অথচ আল্লাহ তাতে বরকত রাখেননি।
• ছোক শির্ক কখনো হয় কথার কারণে,
যেমন কেউ বলল অমুক অমুক তারার কারণে আমরা বৃষ্টি হাসিল করেছি,
‘একমাত্র তারাই বৃষ্টি বর্ষণ করেছে’ যদি এ বিশ্বাস পোষণ না করে। অথবা কেউ গায়রুল্লাহর নামে কসম করল,
যদি গায়রুল্লাহকে সম্মান দেওয়া বা আল্লাহর বরাবর করা উদ্দেশ্য না হয়। অথবা কেউ বলল, যা আল্লাহ ও আপনি চেয়েছেন,
ইত্যাদি।
• ছোট শির্ক কখনো হয় কর্ম দ্বারা,
যেমন কেউ বালামুসিবত দূর বা প্রতিরোধ করার জন্যে তাবিজ লটকালো, অথবা আংটি কিংবা তাগা পরিধান করল। কারণ কোনো বস্তুকে কেউ যখন কোনো কিছুর উপায় নির্ধারণ করে, শরীয়ত বা তাকদীর কোনো বিবেচনায় আল্লাহ যা উপায় নির্ধারণ করেননি, সে আল্লাহর সাথে শির্ক করল। অনুরূপ কেউ যদি বরকতের আশায় কোনো বস্তু স্পর্শ করে, আল্লাহ যাতে বরকত রাখেননি, যেমন মসজিদের দরজা সমূহ চুমু খাওয়া,
তার চৌখাট স্পর্শ করা ও তার মাটি থেকে রোগ মুক্তি কামনা করা ইত্যাদি কর্মসমূহ ছোট শির্ক।
এ হল ছোট শির্ক ও বড় শির্কের সংক্ষিপ্তসার,
বিস্তারিত বর্ণনা এ সংক্ষিপ্ত উত্তরে দেওয়া সম্ভব নয়।
সমাপ্তি:
মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে ছোট-বড় সব শির্ক থেকে বেচে থাকা, কারণ সবচেয়ে বড় নাফরমানি, যা আল্লাহর সাথে করা হয় তা হচ্ছে শির্ক, এবং তার অধিকারে সীমালঙ্ঘন করা, অর্থাৎ তার ইবাদত ও আনুগত্যে শির্ক করা, অথচ তার কোনো শরীক নেই। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের স্থায়ী নিবাস নির্ধারণ করেছেন জাহান্নাম। তিনি বলেছেন, মুশরিকদের তিনি ক্ষমা করবেন না, তাদের উপর জান্নাত হারাম। তিনি ইরশাদ করেন:
﴿ إِنَّ
ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن
يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱفۡتَرَىٰٓ إِثۡمًا عَظِيمًا ٤٨ ﴾
[النساء : ٤٨]
“নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে”।[11]
অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:
﴿ إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ
حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ
مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢ ﴾ [المائدة: ٧٢]
“নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই”।[12]
অতএব প্রত্যেক বিবেকী ও দীনদার ব্যক্তির জন্যে অবশ্য কর্তব্য শির্কের ভয়ে ভীত থাকা ও স্বীয় রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা, তিনি যেন তাকে শির্ক থেকে মুক্তি দেন, যেমন ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম বলেছেন:
﴿ وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ
ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ ﴾ [ابراهيم: ٣٥]
“আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তির ইবাদত থেকে দূরে রাখুন”।[13]
কোনো সালাফ বলেছেন: ইবরাহিমের পর কে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে।
অতএব সত্যিকার বান্দা শির্কের ভয়ে ভীত থাকবে, শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য স্বীয় রবের নিকট আকুতি করবে এটাই স্বাভাবিক। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম “পিপড়ার চলার আওয়াজ থেকেও শির্ক তোমাদের মাঝে অধিক অস্পষ্ট, আমি তোমাকে একটি বিষয় বলছি, যার ফলে আল্লাহ তোমার থেকে ছোট-বড় শির্ক দূর করে দিবেন। তুমি বল:
«اللهم إني أعوذ بك أن أشرك بك وأنا أعلم،
وأستغفرك لما لا أعلم» . صححه الألباني في صحيح الجامع ( 3731 ) .
“হে আল্লাহ, আমার জানাবস্থায় আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই, আর আমি যা জানি না তার জন্য আপনার নিকট ক্ষমা চাই”। [14]
এ যাবত আমরা শির্কের পরিচয় ও তার দু’টি প্রকার সম্পর্কে সংজ্ঞাসহ আলোচনা করলাম।
ছোট শির্ক ও বড় শির্কের হুকুম:
বড় শির্ক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়, ফলে সে কাফির ও মুরতাদ গণ্য হয়।
আর ছোট শির্ক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, তবে সে বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকে, কারণ ছোট শির্কও কবিরা গুনাহ। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “গায়রুল্লাহর নামে সত্য কসম অপেক্ষা আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম আমার নিকট অধিক প্রিয়”।
এখানে আমরা দেখছি তিনি ছোট শির্ক তথা গায়রুল্লাহর নামে কসম খাওয়াকে আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম অপেক্ষা অধিক নিন্দনীয় জ্ঞান করছেন, আর আমরা জানি যে আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা কবিরা গুনাহ।
আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তিনি আমাদেরকে তার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন, যতক্ষণ না আমরা তার সাথে সাক্ষাত করি। আমরা তার নিকট পানাহ চাই, তিনি যেন আমাদেরকে গোমরাহ না করেন। একমাত্র তিনিই চিরঞ্জীব, তিনি কখনো মারা যাবেন না, এ ছাড়া জিন ও মানব সবাই মারা যাবে। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন।
الإسلام سؤال وجواب
[1] সূরা বাকারা: (২২)
[2] ইবরাহীম: (৩০)
[3] বুখারি: (৪৪৯৭), মুসলিম: (৯২)
[4] সূরা বাকারা: (১৬৫)
[5] আলবানি রহ. তার সহি হাদিস সমগ্রে হাদিসটিকে সহি বলেছেন: (৯৫১)
[6] তবে সব ঝাঁড়-ফুক শির্ক নয়। কুরআনের আয়াত ও হাদীসের দো‘আ বা আগত চিকিৎসা দিয়ে ঝাঁড়-ফুক করানো জায়েয। বরং তা উত্তম কাজ। হাদীসে সে ঝাঁড়-ফুকই উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে যার ভিত্তি-কুরআন হাদীস নয়, অথবা ভিন্ন কোনো ভাষায় হয়, যার অর্থ জানা যায় না।
[7] আবু দাউদ: (৩৮৮৩), আলবানি রহ. সহি হাদিস সমগ্রে হাদিসটিকে সহি বলেছেন: (৩৩১)
[8] তবে যদি এগুলোকে সরাসরি কার্যসম্পাদনকারী মনে করা হয়, তবে তা বড় শির্কে পরিণত হবে।
[9] আবু দাউদ: (৩৯১০)
[10] বুখারি: (১০৩৮), মুসলিম: (৭১)
[11] সূরা নিসা: (৪৮)
[12] সূরা মায়েদা: (৭২)
[13] সূরা ইবরাহিম: (৩৫)
[14] সহি আলজামি: (৩৭৩১), আলবানি রহ. হাদিসটি সহি বলেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন