ব্যবসা-বাণিজ্যে নিষিদ্ধ কাজ
মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব-
ক্যাটেগরিঃ ধর্ম বিষয়ক; বুধবার ০৬ এপ্রিল ২০১৬
ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপকতার ফলে নতুন করে তার পরিচিতি পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। মূলত বিনিময় প্রথাকে ব্যবসা-বাণিজ্য বলা হয়। প্রাচীনকালে পণ্যের বিনিময়ে পণ্যের আদান প্রদানের প্রথা চালু ছিল। যাকে ফিকহের পরিভাষায় ‘বাইউল মুকায়াজা’ বলা হয়। কিন্তু এ প্রথায় কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়ায় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য আদান-প্রদানের প্রথা চালু হয়। সাধারণ অর্থে এটাকেই আমরা এখন ব্যবসা-বানিজ্য বলি। আদান-প্রদানের এই প্রথা মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। মানব অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকে এ প্রথা চালু হয়েছে, মানব অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
ব্যবসা-বানিজ্যের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে ইসলাম। হাদিস শরিফে আছে, ‘সৎ আমানতদার ব্যবসায়ী নবীগণের সঙ্গে হাশর করবে’। যেহেতু ব্যবসা-বানিজ্য মানব প্রয়োজনের দিক বিবেচনায় সূচিত হয়েছে, সেহেতু ইসলাম মানব-প্রয়োজনের এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কলুষতামুক্ত রাখার জন্য বেশ কিছু বিধি-বিধান দিয়েছে। একজন সৎ ব্যবসায়ীর নৈতিক দায়িত্ব হলো সে সব বিধানগুলো মেনে চলা। নিম্মে বিধানগুলো আলোচনা করা হলো।
১ প্রতারণার আশ্রয় নেয়া
ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া সম্পূর্ণরূপে
নিষিদ্ধ
ও
হারাম। ক্রেতাকে ঠকানোর জন্য পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা জায়েজ নয়। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। অপর একটি হাদিসে আছে, ‘রাসুলুল্লাহ
(সা.)
প্রতারণামূলক বেচাকেনাকে নিষিদ্ধ করেছেন’। (মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা)। এ বিষয়ে তিরমিযি শরিফে একটি হাদিসে আছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার খাদ্যপণের একটি স্তূপের মধ্যে হাত প্রবেশ করালে কিছুটা আদ্রতা অনুভব করেন, তিনি খাদ্যশস্যের মালিককে বলেন, কি ব্যাপার এ খাদ্যশস্য ভিজা কেন? তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল! এ খাদ্যশস্যের ওপর বৃষ্টির পানি পড়েছিল। রাসুল (সা.) বলেন, তবে ভিজে যাওয়া পণ্য ওপরে রাখলেনা কেন? যাতে মানুষ তা দেখতে পেত। অতঃপর তিনি ইরশাদ করেন, শোন, যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। (মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ ২৪৮)। আরবের লোকেরা দুধের পশু বিক্রি করার সময় প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করত। তারা কয়েক দিন পর্যন্ত পশুটির দুধ দোহন না করে রেখে দিত, এতে স্তনে দুধ জমা হয়ে স্তন ফুেল যেত আর গ্রাহক দেখে মনে করত পশুটি প্রচুর দুধ দেয়, এই ভেবে তারা চড়া মূল্যে তা খরিদ করে প্রতারিত হত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাকে পশু বিক্রি করতে নিষেধ করেন। (বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ)।
২ ওজনে কম দেয়া
ওজনে কম দেয়া অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। ইসলামি শরিয়ত কখনো তা সমর্থন করে না। যারা ওজনে কম দেয় তাদের এ ঘৃণ্য কাজের বর্ণনা দিয়ে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা স্বতন্ত্র একটি সুরা অবতীর্ণ করেন। সেখানে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা পুনরুত্থিত
হবে
কেয়ামতের
দিবসে,
যে
দিন
সমস্ত
মানুষ
দাঁড়াবে
মহান
প্রতিপালকের সামনে?। (সুরা তাতফীফ ১-৬)। এই আয়াতেগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাপে কম দেয়া হারাম ও নিষিদ্ধ। তবে মনে রাখতে হবে, ‘তাতফীফ’ শব্দের অর্থ শুধু মাপে কম দেয়া নয়; বরং যে কোনো প্রাপককে যথাযথ প্রাপ্য না দেয়া। সেটা গণনার মাধ্যমে হতে পারে আথবা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। প্রাপককে আপন হক থেকে বঞ্চিত করাই মূল উদ্দেশ্য।
৩ মজুদ দারী
আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য মজুদ বা ষ্টক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং মানবতার প্রতি চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনের
শামিল। কিছু মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্টে দিনাতিপাত করবে, আর কিছু মানুষ নিজেদের হীন স্বার্থ চরির্তাথ করার জন্য কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করবে- এটা ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মজুদদারী করে সে পাপাচারী’। (শুয়াবুল ঈমান) তবে মনে রাখতে হবে, মজুদদারী সর্বাবস্থায়
নিষিদ্ধ
নয়। যদি মজুদদরীর কারণে বাজারে পণ্য-সংকট সৃষ্টি না হয়, অথবা সে উদ্দেশ্যে মজুদদরী করা না হয় তবে তা জায়েজ। সুতরাং মৌসুমের বিপুল আমদানিকালে
কম
মূল্যে
পণ্য
খরিদ
করে
স্টক
করে
রেখে
পরে
তা
অধিক
মূল্যে
বিক্রি
করা
বৈধ। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য বাজারে ছেড়ে দেয়া সর্বাবস্থায়ই উত্তম।
৪ মিথ্যার আশ্রয় নেয়া
আজকাল মিথ্যা কথা বলা ব্যবসায়ীদের
একটি
চিরাচরিত
অভ্যাসে
পরিণত
হয়ে
গেছে। তারা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা শপথ করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না। পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পরস্পর সম্মতিক্রমে বেচাকেনার মাধ্যমে’। (সুরা নিসা ২৯) রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ব্যবসা-বানিজ্যকে মিথ্যার কলুষতা থেকে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘বেচাকেনার সময় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত লেনদেন গ্রহণ ও বর্জন করার অধিকার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সংরক্ষণ করে। তারা যদি পণ্য ও বিনিময় দ্রব্যের গুণাগুণ যথাযথ বর্ণনা করেন এবং সত্য কথা বলেন, তবে তাদের বেচাকেনার মধ্যে বরকত দেয়া হয়। আর যদি মিথ্যা বলেন কিংবা গুণাগুণ গোপন করেন, তবে বেচাকেনার বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়’। অপর এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ
(সা.)
ইরশাদ
করেন,
‘যে
ব্যক্তি
পণ্যের
দোষ-ত্রুটি ক্রেতার নিকট প্রকাশ করে না, সে সর্বদা আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত থাকে।’
৫ মিথ্যা শপথ করা
এমনিতেই মিথ্যা শপথ করা মারাত্মক গুণাহের কাজ। তার ওপর ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে এর নিষেধাজ্ঞা
আরো
বেশি। কারণ ব্যবসা-বানিজ্যে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে। অথচ আমাদের সমাজের ব্যবসায়ীদের প্রায়ই দেখা যায়, তারা পণ্যকে বেশি দামে বিক্রয় করার জন্য মিথ্যা শপথ করে । যেমন একটি পণ্য বিক্রেতার ১০ টাকা কেনা পড়েছে, সে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে আল্লাহর কসম আমি এই পণ্যটি ১৫ টাকায় কিনেছি। ক্রেতা তার কথার ওপর ভিত্তি করে চড়া মূল্যে তা খরিদ করে নিয়ে যায় এবং প্রতারণার শিকার হয়। মিথ্যা শপথের ব্যাপারে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর পথে কৃত অঙ্গিকার সামান্য মূল্যে বিক্রি করে তাদের আখেরাতে কোনো অংশ নেই। আর তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামেতের দিবসে কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দিবেন না। তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না । বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি । (আল ইমরান ৭৭) উক্ত আয়াত সম্পর্কে হযরত আবু যর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদেরকে মার্জনা করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক
শাস্তি। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা হলো অনুগ্রহ করর পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। অতঃপর রাসুল (সা.) এই আয়াত পড়েন। (মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ ২৪৩)।
অপর এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা দ্বারা কারও হক নষ্ট করে সে নিজের জন্য জাহান্নামের
শাস্তি
অবধারিত
করে
নেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। বর্ণনাকারী আরজ করলেন, যদি বিষয়টি সামান্য পরিমানে হয় তবুও? উত্তরে তিনি ইরশাদ করেন, তা গাছের একটি তাজা গাছের ডালই হোক না কেন।’
৬ সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা
ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা উচিত। কারণ একবার শপথ করার অভ্যাস হয়ে গেলে তা আর ফিরানো যায় না। তাছাড়া বেশি বেশি শপথ করা এটা ইসলামের দৃষ্টিতেও খারাপ কাজ। এ কারণেই ফকিহগণ সত্য শপথ করাকেও মাকরুহ বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, শপথ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঠিক, কিন্তু তা ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়। অপর বর্ণনায় আছে ‘তোমরা বেচাকেনার ক্ষেত্রে অধিক শপথ থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও বরকত নষ্ট করে দেয়।’ (মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ ২৪৩)
৭ কারো দরদামের ওপর দরদাম না করা
অনেক সময় দেখা যায় একজন একটা বস্তুর দরদাম করছে, পাশ থেকে আরেক জন এসে বেশি দামে বস্তুটা নিয়ে যায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ক্রেতা বিক্রেতার চূর্ড়ান্ত কথাবার্তা শেষ হওয়ার আগে অপর কেউ তার ওপর দামাদমি করা ইসলামি শারিয়দে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ বিক্রেতা গ্রাহক সংখ্যা বেশি দেখে পণ্যের দাম ন্যায্য মূল্য থেকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে সাধারণ আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। তাই রাসুল (সা.) এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, এক জনের দরদামের ওপর দরদাম কর না।(তিরমিযি ২৪২)। তবে ক্রেতা বিক্রেতার কথা চুড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেলে তৃতীয় কোনো খরিদদার তা মুলাতে পারবে।
৮ সংশয়পূর্ণ লেনদেন থেকে বিরত থাকা
ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছু বিষয় স্পষ্ট হালাল। কিছু বিষয় স্পষ্ট হারাম যা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। আর কিছু বিষয় আছে সংশয়পূর্ণ সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে না যে, বিষয়টি কি হালাল না হারাম? সে ক্ষেত্রে সৎ ব্যবসায়ীর দয়িত্ব সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। ইসলামও সন্দেহ সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়।
সম্পাদক: মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন